প্রকাশ: বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ৮:৪৮ এএম (ভিজিটর : )
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এটি এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৮৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। এর মধ্যে অন্তত ৫০ জনকে উদ্ধার করেছে র্যাব ও পুলিশ। অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির এসব ঘটনায় আতঙ্কে দিন পার করছেন বনপ্রহরী ও বনরক্ষীরাও। এমন অবস্থায় বনরক্ষায় দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। অনেকে আতঙ্কে বনে যেতেও ভয় পাচ্ছেন।
সর্বশেষ প্রতিদিনের মতো ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়েছিলেন মালয়েশিয়াপ্রবাসী মো. শাকের আহমদ (৬০)। এরপর সারা দিনও তার কোনও খোঁজ পাননি স্বজনরা। রাতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ফোন করে জানানো হয়, তাকে অপহরণ করা হয়েছে। জীবিত ফিরে পেতে চাইলে দিতে হবে ৫০ লাখ টাকা। সোমবার সকালে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যংয়ের ঘোনারপাড়া থেকে নিখোঁজ হন শাকের আহমদ।
গত ৩০ ডিসেম্বর টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা পাহাড় থেকে ১৯ জন বনপ্রহরীকে অপহরণ করা হয়। ওই দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী টেকনাফ সীমান্ত পরিদর্শনে এসেছিলেন। ২ জানুয়ারি বনপ্রহরীদের উদ্ধার করেছিল র্যাব। গত ১০ জানুয়ারি দিনদুপুরে হোয়াইক্যংয়ের হরিকুলার বুড়াবুনিয়া বনে মুখোশধারী অস্ত্রধারীরা গুলি ছুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে। এতে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। ভয়ে বন এলাকা ত্যাগ করেন বনপ্রহরী। এরপর থেকে সেখানে যাননি তারা।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ উপজেলায় বনাঞ্চলের পরিমাণ ১৮ হাজার ২৫০ হেক্টর। এর মধ্যে হোয়াইক্যং রেঞ্জে পাঁচ হাজার ৪২৭, শীলখালী রেঞ্জে ছয় হাজার ২০০ এবং টেকনাফ রেঞ্জে ছয় হাজার ৬২৪ হেক্টর বন। বনপ্রহরী রয়েছেন ৪১৫ জন। অর্থাৎ গড়ে ৪৫ হেক্টর বনাঞ্চলে পাহারার দায়িত্ব পালন করেন একজন প্রহরী। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) অর্থয়ানে নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের অধীনে এসব বনাঞ্চলে পাহারায় দায়িত্ব পালন করছেন ৪১৫ জন বনপ্রহরী। তাদের দেখভাল করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেক। বনাঞ্চল প্রহরীদের পাশাপাশি সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দেখভাল করা হয়। তবু প্রহরী সংকটের কারণে গাছ চুরিসহ বনকেন্দ্রিক অপরাধ ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে অপহরণের ঘটনা আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েকটি অস্ত্রধারী গোষ্ঠী বনকেন্দ্রিক অপহরণ বাণিজ্যে যুক্ত।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দায়িত্ব পালনের সময় বনপ্রহরীদের সবার কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গুলি থাকে না। নিরস্ত্র অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় প্রহরীরা বনে অস্ত্রধারীদের হাতে মারধর কিংবা অহরণের শিকার হন। বনাঞ্চল রক্ষায় প্রহরী বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র প্রয়োজন বলছেন তারা।
এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের সমন্বয়কারী মো. শওকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টেকনাফে আমাদের ৪১৫ জন বনপ্রহরী দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এর মধ্যে আমার সাইটের অধীনে ২১৯ জন রয়েছেন। তবে সম্প্রতি বন ও পাহাড়ে অপহরণ, মুক্তিপণ বাণিজ্যের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আমরা বনপ্রহরীদের নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। কিছুদিন আগে বন থেকে ১৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। তার আগে আমাদের তিন বনপ্রহরীকে ধরে নিয়ে ৬০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। পরে তাদের কোনোমতে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এখন প্রায় নিত্যদিন অপহরণের ঘটনা ঘটছে।’
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে হ্নীলা ইউনিয়নের মোচনি বিটের নেচার পার্ক বনে পাহারা দিচ্ছিলেন বনপ্রহরী মো. শাকের, আবদুর রহমান এবং আবদুর রহিম। সে সময় অস্ত্রধারীরা তাদের জিম্মি করে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের পরিবারের কাছে ৬০ লাখ টাকা দাবি করেছিল অপহরণকারীরা।
আবদুর রহমান এবং আবদুর রহিম জানিয়েছেন, আগের চেয়ে বর্তমানে বেড়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য। গত বছর ১৮৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশ মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন।
কয়েকজন বনপ্রহরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টেকনাফের হোয়াইক্যং, জাদিমোরা পাহাড়, ঘোনারপাড়া, লেদা, মৌচনি, নেচার পার্ক, রাজারছড়া, বাহারছড়া ও শীলখালী অপহরণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি মাঠপাড়া, শিয়াল্যাগুনা, বেতবনিয়া, হরবইন্ন্যার জোড়া, বরছড়া, বালুর মাঠ ও বড় ছংকলা থেকেও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। কয়েকটি গ্রুপ লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের বাণিজ্যে নেমেছে।
টেকনাফের বনাঞ্চলের পাঁচ বাগান পাহারার দায়িত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ উল্লাহ। তার অধীনে ২১ বনপ্রহরী রয়েছেন। তারা ২০০ হেক্টর বনের গর্জন-সেগুনসহ বিভিন্ন বাগানের পাশাপাশি বনরক্ষার দায়িত্বে আছেন।
মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ‘গড়া বাগানের পরিষ্কারের কাজ চলমান আছে। কিন্তু অপহরণের ভয়ে মাঝখানে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কারণ সম্প্রতি বনে কাজ করতে যাওয়া ১৯ জন শ্রমিক অপহরণের শিকার হন। এরপর থেকে বনের প্রহরীরা আতঙ্কে আছেন। আগের মতো কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তা ছাড়া বনের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে মুখোশ পরা অস্ত্রধারীদের দেখেছি আমরা।’
বনকে ভালোবেসে টেকনাফের হোয়ানক ইউনিয়নের কেরুনতলীর বাসিন্দা খুরশিদা বেগম পেয়েছিলেন ওয়াংগারি মাথাই পুরস্কার। ২০১২ সালে পরিবেশ নিয়ে কর্মরত বিশ্বের ৫০০ জন নারীকে পেছনে ফেলে খুরশিদা আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি পান। তিনি ২০০৬ সালে ২৮ জন নারীর দল নিয়ে দিনে ১০ টাকার বিনিময়ে বনপ্রহরীর দায়িত্ব পালন শুরু করেন। খুরশিদা বেগম বলেন, ‘বনের পাঁচটি বাগান ২৮ জন নারী প্রহরীকে নিয়ে রক্ষা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখন বনে প্রায় প্রতিদিন অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। বনে যেতে ভয় পাচ্ছি আমরা। এভাবে চলছে বনরক্ষা করবো কীভাবে? সরকারের উচিত বনকে নিরাপদ করে তুলতে অস্ত্রধারীদের দ্রুত গ্রেফতার করা। প্রায় সময়ে বনে অস্ত্রধারীদের চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে।’
বন এখন প্রহরীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে জানালেন টেকনাফ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের উচিত বনকে নিরাপদ করে তুলতে সেখানে যৌথ অভিযান চালানো। অন্যথায় বনরক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি বনরক্ষার স্বার্থে আমাদের জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের কারও কাছে কোনও ধরনের অস্ত্র নেই।’
কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (টেকনাফ ও উখিয়া) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণ আতঙ্কে আছেন বনপ্রহরীরা। তবে আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি যাতে নিরাপদে বন পাহারায় নিয়োজিত থাকতে পারেন তারা। পাশাপাশি বনে অপহরণ গোষ্ঠীকে ধরতে সব পক্ষকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫০ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৭৮ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে।