সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সংস্থা তথ্য অধিদফতর (পিআইডি) ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সংস্থা সরকারি আবাসন পরিদফতরকে সচিবালয়ের বাইরে স্থানান্তর করার কথা ভাবছে সরকার। কারণ হিসেবে জানা গেছে, এ দুটি সংস্থা থেকে যারা সেবা পেতে চান তাদের সচিবালয়ের ভেতরে আসতে পাস জোগাড় করতে হয়, যা কষ্টসাধ্য। অপরদিকে, পাস নিয়ে ভেতরে প্রবেশের ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হুমকির বিষয়টিও সামনে চলে আসে। এসব কারণেই মূলত এ দুটি সংস্থার কার্যক্রম সচিবালয়ের বাইরে কোথাও স্থানান্তর করা যায় কিনা তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ সচিবালয় শুধু মন্ত্রী ও সচিবদের দফতর, যেখানে সরকারের মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। সেখানে মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থার সরাসরি দাফতরিক কাজকর্ম পরিচালনা অনেকটাই বেমানান। এ ছাড়া সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাগুলো সচিবালয়ের বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শুধু সরকারি এই দুটি সংস্থা সচিবালয়ের ভেতরে তাদের দাফতরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ফলে এতদিন বিষয়টি নিয়ে তেমন কেউ মাথা না ঘামালেও ২৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অনেকের টনক নড়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে সরকারি সংশ্লিষ্ট মহল।
জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ প্রচার ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে তথ্য অধিদফতর। যেটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি সংস্থা। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, নীতি ও কার্যক্রমের যাবতীয় সংবাদ প্রচার করা তথ্য অধিদফতরের অন্যতম প্রধান কাজ। এ ছাড়া সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ইস্যুর বিষয়টিও তথ্য অধিদফতর বা পিআইডি তদারকি করে। সচিবালয়সহ স্বাধীনতা পূর্বকালীন ঢাকা আঞ্চলিক তথ্য অফিস স্বাধীনতা উত্তরকালে তথ্য অধিদফতর হিসেবে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে এনাম কমিটির সুপারিশক্রমে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন গবেষণা ও তথ্য সংরক্ষণ (রিসার্স অ্যান্ড রেফারেন্স) উইংকে তথ্য অধিদফতরের সঙ্গে একীভূত করা হয়। এছাড়া সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রচার সেলকেও ফিচার শাখা নামে তথ্য অধিদফতরের সঙ্গে একীভূত করা হয়। জাতীয় প্রেক্ষাপট ও সময়ের প্রয়োজনে তথ্য অধিদফতরের বর্তমান অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে সাতটি বিভাগে (রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর) আঞ্চলিক তথ্য অফিস তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তথ্য অধিদফতর-পিআইডি ছাড়া তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অপরাপর সংস্থা- বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর, গণযোগাযোগ অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড, তথ্য কমিশন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট সচিবালয়ের বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তাদের দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অপরদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে সরকারি বাসা, বাড়ি বরাদ্দ ও ভাড়া আদায় সংক্রান্ত ৪টি প্রতিষ্ঠান ছিল। সেগুলো হলো- কেন্দ্রীয় এস্টেট অফিস, ঢাকা, (২) প্রাদেশিক এস্টেট অফিস, ঢাকা, (৩) আঞ্চলিক এস্টেট অফিস, চট্টগ্রাম ও (৪) বিশ্রামাগার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই চারটি অফিস একীভূত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা হিসেবে সরকারি বাসস্থান পরিদফতর এবং পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে সরকারি আবাসন পরিদফতর হিসেবে নামকরণ করা হয়। চট্টগ্রামে এর একটি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তাদের সরকারি বাসা বরাদ্দ ও বাতিলের বিষয়টি তদারকি করে সরকারি আবাসন পরিদফতর। এখানে সচিবালয়ের বাইরে থেকে সরকারি বাসার তদবিরে বিপুল সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আগমন ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি আবাসন পরিদফতর ছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাকি অধিদফতর—গণপূর্ত অধিদফতর, নগর উন্নয়ন অধিদফতর, এইচবিআরআই স্থাপত্য অধিদফতর এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদফতর—অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিদফতর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানসহ দেশের সংশ্লিষ্ট জেলায় তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
অপরদিকে, বাংলাদেশ সচিবালয় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক সদর দফতর। বাংলাদেশ সরকারের সকল নির্বাহী বিভাগীয় কার্য সচিবালয়ে সম্পন্ন হয়। এখানেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা উপদেষ্টাদের দফতর। সচিবালয়ের অভ্যন্তরে সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার দফতরও রয়েছে। এখানেই মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা অর্থাৎ সচিবদের দফতরও এই সচিবালয়ে অবস্থিত। বাংলাদেশ সচিবালয় কেপিআইভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। গুরুত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ সচিবালয় খুবই স্পর্শকাতর স্থাপনা। নিরাপত্তার দিক থেকে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা ও সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশ সচিবালয়।
জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে নির্মিত একগুচ্ছ ভবন নিয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় গঠিত হয়। যা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এটিকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ছিল সাবেক সরকারের। সাবেক সরকার একসময় সচিবালয়কে তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আরও নিকটবর্তী করতে শেরেবাংলা নগরে নতুন সচিবালয় তৈরির পরিকল্পনা করেছিল। সেখানে নতুন ভবনটি বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই কানের তৈরি জাতীয় সংসদ ভবনের নকশার অনুরূপ করার চিন্তা করা হয়েছিল। বর্তমান ভবনের বিকল্প প্রস্তাব করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কমিটি গঠন করে। এটি ১৪ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর চারটি ৯ তলা ভবনসহ ৩২ একর জমির ওপর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। তবে আপাতত রমনা থেকে সচিবালয় সরানোর চিন্তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দফতর পুড়ে যায়। ভবনটির চারটি তলায় অবস্থিত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; সড়ক পরিবহন ও সেতু, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র, কম্পিউটার ও আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুন নির্বাপণ করতে গিয়ে পানির সরবরাহ লাইন সংযোগ দেওয়ার সময় ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী ট্রাকচাপায় নিহত হন। নজিরবিহীন এ আগুনের ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেখান থেকেই আলোচিত ওই দুই সংস্থা সরানোর চিন্তার সূত্রপাত বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সচিবালয় হচ্ছে মন্ত্রী-উপদেষ্টা ও সচিবদের দফতর। সেখানে কোনও অধিদফতর বা পরিদফতরের দফতর থাকা শোভনীয় নয়। এ দুটি সংস্থা ছাড়া সব সংস্থাই তো বাইরে। এ দুটি সংস্থা কেন সচিবালয়ের ভেতরে থাকবে? এ ছাড়া সচিবালয়ের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। বিষয়টি এখনই চূড়ান্ত করা হয়নি। আলাপ-আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
অপরদিকে, তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (পিআইও) নিজামুল কবীর ও সরকারি আবাসন পরিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক আবু জাফর রাশেদ জানিয়েছেন, বিষয়টি আমাদের জানা নাই।