প্রকাশ: শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪, ৬:৩৯ এএম (ভিজিটর : )
প্রাথমিকেই ঝরে পড়ছে চরাঞ্চলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। উত্তরের জেলা গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে নেই কোনো পর্যাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কলেজ। পর্যাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শেষে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় বেশিরভাগ। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় প্রাথমিক পেরিয়ে তারা বিভিন্ন চা দোকান, মোটরসাইকেল মেরামতের দোকান কিংবা মুদি দোকানে কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে এ অবস্থায় মেয়েদের ক্ষেত্রে বাড়ছে বাল্যবিয়ের হার। উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনায় জেগে ওঠা ছোট-বড় সবমিলিয়ে ১৬০ থেকে ১৭০টি চর-দ্বীপচর রয়েছে। ঝরেপড়া এ শিশুরা সেখানে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে। জেলার চার উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের মধ্যে বিস্তৃতি রয়েছে এসব চরের।
গাইবান্ধার চার উপজেলার চরাঞ্চলে প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে। সাক্ষরতার হার ৬৬.৮৭%। স্বাধীন দেশের নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরাঞ্চলের হাজারো শিক্ষার্থী। নদীবেষ্টিত এসব চরাঞ্চলে ১১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক স্কুল ও মাদরাসা নেই বললেই চলে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১২টি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের মাদরাসা রয়েছে ৩টি। চরাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদার তুলনায় এই কয়েকটি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারেই কম। তারপর আবার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ১৬০টি দ্বীপচরের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটিও কলেজ ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরপরই পড়াশোনা করা হয়ে উঠে না। কলেজ না থাকায় চরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ঝরে পড়ে অকালে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জেলার সামগ্রিক শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ওপর। শিক্ষার্থীরা অকালে ঝরে পড়ার কারণে অনেকেই জড়িয়ে পড়ে বাল্যবিয়েসহ শিশুশ্রমে। গাইবান্ধার চরাঞ্চলের ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিই হতে পারে না। যারা ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। এর পেছনে দরিদ্রতা, চর এলাকায় পর্যাপ্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকা, এলাকার অভিভাবকদের অসচেতনতা, কষ্টসাধ্য যাতায়াতব্যবস্থা এবং বাল্যবিয়ে অন্যতম।
চরাঞ্চলের অভিভাবক রফিকুল ইসলাম বলেন, অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাই। আমার তো আর অনেক টাকা-পয়সা নেই যে মেয়েকে শহরে রেখে পড়ালেখা করাব। দিন কাজ করে পাই পাঁচশ টাকা আর বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে এ অর্থে আমার পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। যদি বাড়ির পাশে একটা স্কুল থাকত তা হলে হামার ভালো হতো।
আরেক বাসিন্দা রঞ্জু মিয়া বলেন, ধু ধু বালু চর পথ পেরিয়ে একটা মেয়েকে আমি কীভাবে ওপারে যেতে দিই? ফাঁকা রাস্তা-ভয় লাগে কখন কী হয়।
স্থানীয়রা বলছে, প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে আর পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না। এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। আবার নদীভাঙন ও দরিদ্রতার করালগ্রাসে অনেকের অর্থনৈতিক অবস্থার বেহাল দশা। নানা কারণে তাদের সন্তানকে শহরের স্কুলে পড়ানোর সাধ্য তাদের নেই। তবে কিছু অভিভাবকের সামর্থ্য আছে, কেবল তারাই সন্তানদের শহরে আবাসিক হোস্টেল বা মেসে রেখে পড়াশোনা করাতে পারেন।
তারা বলেন, চরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অনেক শিক্ষার্থী যথেষ্ট মেধাবী। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাইবান্ধার চরের শিক্ষার্থীদের বিচরণ রয়েছে। এ থেকে আমরা বলতেই পারি ইচ্ছে থাকলেও যেন উপায় মিলছে না। যেহেতু চরগুলো প্রায়ই নদীভাঙনের কবলে পড়ে সেক্ষেত্রে প্রতিটি চরে অস্থায়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হলে ওইসব এলাকার ছাত্রছাত্রীদের অকালে ঝরেপড়া থেকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব হবে তেমনি বাড়বে শিক্ষার হার। তাই চরাঞ্চলবাসীর দাবি, বর্তমান সরকার সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমকে যেভাবে এগিয়ে নিচ্ছে তেমনি চরাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের জন্যও সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
চরাঞ্চলের কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলে, আমরা চর থেকে এসে কালির বাজারে মেসে থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। পরীক্ষা শেষ হলে উচ্চশিক্ষার জন্য কোথায় ভর্তি হবো-তা জানা নেই। কারণ চরাঞ্চলে আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো কলেজ নেই। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও অসচ্ছল। তাই শহর বা উপজেলা শহরে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালানোর টাকা জোগানো আমাদের পরিবারের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি=চরাঞ্চলে অন্তত একটি কলেজ স্থাপন করা হোক। তা হলে আমরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, বর্তমান সরকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। আমি নির্বাচিত হওয়ার পরই ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়ন ও ফজলুপুর ইউনিয়নের মাঝামাঝি একটি টেকনিক্যাল স্কুল ও একটি কলেজ করার প্রস্তুতি নিয়েছি, যা অল্প সময়ে বাস্তবায়ন হবে। আমি চরাঞ্চলের মানুষকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। চরাঞ্চলের মানুষের শিক্ষা ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করতে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করছি, যা দ্রুতই বাস্তবায়ন হবে।